Wednesday, May 21, 2025

হাওড়া ব্রিজ (Howrah Bridge) – কিভাবে রবীন্দ্র সেতু বা হাওড়া ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়েছিল?

History of Howrah Bridge in Bengali

Share

(History of Howrah Bridge in Bengali)

মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে বিশ্বজুড়ে নানান নির্মাণকার্য আজও চলছে। আর এই নির্মাণকার্যের ইতিহাসে অনেক নির্মাণই আজও আমাদের কাছে বিস্ময়কর। যা ঐতিহাসিক কাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত বছরের পর বছর ঠিক প্রায় একই ভাবে টিকে রয়েছে। এমনই এক নির্মাণের নিদর্শন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে হুগলি নদীর উপর অবস্থিত হাওড়া ব্রিজ বা রবীন্দ্র সেতু। যা বর্তমানে বিশ্বের ষষ্ঠ দীর্ঘতম ক্যান্টিলিভার ব্রিজ বা বহির্বাহু সেতু। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী শহর কোলকাতার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের আর এক বিশেষ শহর হাওড়ার সংযােগ রক্ষার্থে এই সেতুটি নির্মান করা হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ব্যস্ততম বহির্বাহু সেতু হিসাবে স্বীকৃত এই হাওড়া ব্রিজ দিয়ে প্রতিদিন প্রায় দেড় লক্ষ পথযাত্রী এবং প্রায় এক লক্ষ যানবাহন চলাচল করে। তাহলে চলুন বছরের পর বছর ধরে মাথা উচু করে দাড়িয়ে থাকা এই হাওড়া ব্রিজটির নির্মাণ কার্যের ইতিহাস ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে আসি –

হাওড়া ব্রিজ (Howrah Bridge)


Howrah bridge view from Howrah district
Howrah bridge view from Howrah district

নির্মাণ কার্যের ইতিহাস

১৮৫৫ সাল, ভারতেও ব্রিটিশদের বাণিজ্যিক স্থাপত্য বিস্তার লাভ করে এবং মজবুত হয় ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা। কোলকাতা তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হয়ে ওঠে। এই রাজধানী শহর কোলকাতার গা ঘেঁষে বয়ে গেছে হুগলি নদী, যার দুপারেই বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে ইংরেজদের কারবার, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন কল-কারখানা। ফলে অপরপ্রান্তের হাওড়াও তখন হয়ে ওঠে একটি বিশিষ্ট শহর। তাই হুগলি নদীর এই দুইপার অর্থাৎ হাওড়া ও কোলকাতার মধ্যে সংযােগের জন্য একটি সেতু এবার ভীষণ দরকার। কেনােনা মাল-সরঞ্জাম কিংবা লােকেদের নদী পারাপারের জন্য নৌকা বা স্টীমার আর পােসাচ্ছে না। ঠিক এইসময়ই ব্রিটিশ প্রশাসন প্রথম একটি সেতু নির্মাণের কথা ভাবে। সেতুটি ঠিক কি উপায়ে তৈরি হতে পারে এই বিষয়ে আলােচনার জন্য তৈরি হয় একটি কমিটি। তবে এই কমিটি সেতু নির্মাণের চর্চা শুরু করলেও শেষমেশ কোনাে এক অজানা কারণে বছর চারেক পর এই চর্চা ধীর হয়ে পরে। পরবর্তীতে ১৮৬২ সালে বাংলার সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির চীফ ইঞ্জিনিয়ার জর্জ টার্নবুলকে হুগলি নদীর উপর একটি ব্রিজ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা বলেন। সেই অনুসারে ২৯ এ মার্চ জর্জ টার্নবুল প্রয়ােজনীয় নকশা ও তথ্যসমূহ সরকারের সামনে উপস্থাপন করেন। তবে এরপরও ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়ে ওঠেনি।

পেরিয়ে যায় আরও আটটি বছর। আট বছর পর ঠিক হয়, এবার একটি সেতু বানাতেই হবে। সেই সময় তৎকালীন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর সিদ্ধান্ত নেন, সেতু নির্মাণের যাবতীয় দায়িত্ব সরাসরি সরকারের হাতে থাকবে না। তাই ১৮৭১ সালে তৈরি হয় কোলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট এবং তৈরি হয় হাওড়া ব্রিজ অ্যাক্ট। অবশেষে এই ট্রাস্টের অধীনেই তৈরি হয় হাওড়ার প্রথম পন্টন ব্রিজ বা ভাসমান সেতু। এই পন্টন ব্রিজ বা ভাসমান সেতুটি নীচে নৌকা এবং উপরে পটাতন দিয়ে তৈরি হয়। ব্রিজটি লম্বায় হয় ১,৫২৮ ফুট এবং চওড়ায় ৪৮ ফুট। জাহাজ-স্টিমার চলাচলের জন্য ব্রিজটির মাঝ বরাবর ২০০ ফুট খুলে দেওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়। আর এই সম্পূর্ণ ব্রিজটির নকশা বানিয়েছিলেন তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির খ্যাতনামা ইঞ্জিনিয়ার স্যার ব্র্যাডফোর্ড লেসলি।

Howrah Bridge, a photo c.1890's
হাওড়া ব্রিজ, ১৮৯০ সালের একটি ছবি (Howrah Bridge, a photo c.1890’s)

১৮৭৪ সালে যান চলাচলের জন্য এই সেতু খুলে দেওয়া হয়। তবে সেতু পেরােতে বসানাে হয় টোল এই টোলের টাকাতেই চলত সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ। সে সময় এই পন্টন ব্রিজ বা ভাসমান সেতুটি বানাতে খরচ হয়েছিল সর্বমােট ২২ লক্ষ টাকা। তবে যতদিন পর্যন্ত এই সেতু ছিল ততদিনে এই সেতু থেকে সর্বমােট টোল আদায় হয়েছিল ৩৪ লক্ষ ১১ হাজার টাকা। বছরে কমপক্ষে দেড় লক্ষ টাকা টোল আদায় হয়েছে সে সময়। তবে এই ভাসমান সেতুর সবচেয়ে বড়াে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় জাহাজ-স্টিমার চলাচলের ব্যবস্থা করা। কেনােনা জাহাজ গেলেই এই সেতুর মাঝখান বরাবর খুলে দিতে হয়, ফলে গাড়ি চলাচলের জন্য এই ব্রিজটি তখন বন্ধ হয়ে যায়। এই কারণেই দিনের পর দিন বাড়তে থাকে যানজট। এই সমস্যার সমাধানের জন্য সে সময় হাওড়াতে একটি নতুন সেতু নির্মাণের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করতে থাকে ব্রিটিশ সরকার।

The Old Howrah Bridge in 1905
১৯০৫ সালের পুরাতন হাওড়া ব্রিজ (The Old Howrah Bridge in 1905)

ফলে পরবর্তীতে ১৯০৬ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দরের চীফ ইঞ্জিনিয়ার জন কট, ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের চীফ ইঞ্জিনিয়ার আর এস হাটে এবং কোলকাতা কর্পোরেশন এর চীফ ইঞ্জিনিয়ার ডাব্লিউবি ম্যাকাবে এর নেতৃত্বে একটি কমিটি নিয়ােগ করে। এই কমিটির উদ্যোগে সকলপুকার তথ্যের ভিত্তিতে নদীটির উপর একটি ভাসমান সেতুর বদলে একটি ক্যান্টিলিভার ব্রিজ বা বহির্বাহু সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এই সিদ্ধান্ত মােটেই পছন্দ হয়নি স্যার লেসলি ও অনেকেরই। কারণ তখনও পর্যন্ত পৃথিবীতে মাত্র তিনটি ক্যান্টিলিভার ব্রিজ বানানাে হয়েছে। এছাড়াও, এর মধ্যেই ১৯১৭ সালে ক্যান্টিলিভার ব্রিজ প্রযুক্তিতে তৈরি কানাডার পোঁ দ্য কেবেক সেতু ভেঙে পড়েছিল। এছাড়াও, ১৯১১ সালে কমিটি যখন নতুন হাওড়া সেতু নির্মাণের জন্য বিভিন্ন সংস্থা থেকে নকশা চেয়েছিল তখন সারা বিশ্ব থেকে ৯টি সংস্থা ১৮টি নকশা জমা দেয় যার সব কয়টি নকশাই বাসকুল মডেলের অর্থাৎ সেতুর মাঝ বরাবর খােলা রাখার ব্যবস্থা রেখেছিল সব সংস্থাই। তবে যাই হােক, এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে নতুন সেতু নির্মাণের এই চর্চা স্থগিত রাখা হয়। কেননা ১৯১৭ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত যুদ্ধের কবলে পড়ে ব্রিটিশ অর্থনীতিও অনেকটা কমে যায়। ফলে, ব্রিটিশ সরকার নতুন কোনাে প্রকল্পকে কার্যকরী করার থেকে সরে আসে।

তবে ১৯২১ সালে নতুন করে আবারও শুরু হয় চর্চা। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ পুশাসন স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখােপধ্যায়, যিনি তখন মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানির অন্যতম মালিক, তাকে নিয়ে পূনরায় নতুন কমিটি গড়ে দেন। এই কমিটির সদস্য ছিলেন তৎকালীন কোলকাতা বন্দরের চেয়ারম্যান ক্লিমেন্ট হিন্ডলে ও চিফ ইঞ্জিনিয়ার জে ম্যাগ্লাসন। কমিটি তখন তৎকালীন বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার স্যার বেসিল মট-এর পরামর্শ গ্রহণ করেন এবং স্যার বেসিল মটই কমিটির সামনে প্রথম সিঙ্গল স্পর্ন আর্চড ব্রিজের প্রস্তাব রাখেন। এরপর ১৯২২ সালে আর এন মুখার্জি কমিটি চুড়ান্ত রিপের্ট পেশ করেন। তাতে যাবতীয় বিতর্ক সরিয়ে ক্যান্টিলিভার ব্রিজ বা বহির্বাহু সেতু নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। অবশেষে ঠিক হয় এমন একটি প্রযুক্তি হবে যাতে সেতুর নীচ দিয়ে অনায়াসেই। জাহাজ-স্টীমার চলাচল করতে পারবে। সেই হিসাবে ১৯২৬ সালে পাশ হয়। দ্য নিউ হাওড়া ব্রিজ অ্যাক্ট। সম্ভবত হাওড়া ব্রিজ ভারতের প্রথম সেতু যার নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি আইনসিদ্ধ৷ অবশেষে আইন পাশ হবার পর ১৯৩০ সালের ১৫ই মার্চ বাংলার গভর্নর বৈঠকে ডেকে সেতু নির্মাণের জন্য এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

পরবর্তীতে ১৯৩৫ সালে এই নতুন হাওড়া ব্রিজ আইনটি সংশােধিত হয় এবং এর পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৩৬ সালে হাওড়া ব্রিজ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ব্রিজ নির্মাণে ফ্যাব্রিকেশনের কাজ করে বিবিজে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড এবং এই নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে।

Howrah Bridge – 1945; Source – https://commons.wikimedia.org/

হাওড়া ব্রিজ নির্মাণে মােট ইস্পাত লেগেছিল ২৬ হাজার ৫০০ টন, তার মধ্যে। ২৩ হাজার ৫০০ টন ইস্পাত সরবরাহ করেছিল টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি লিমিটেড। বলা যেতে পারে, এই সেতুই সম্ভবত ভারতের প্রথম। মেক ইন ইন্ডিয়া প্রকল্প, যার কাঁচামালের সবটাই ভারত থেকেই নেওয়া হয়েছিল।

Howrah Bridge view

নব নির্মিত এই হাওড়া ব্রিজের মোট দৈর্ঘ্য হয় ৭০৫ মিটার, মােট চওড়া ৩০ মিটার এবং উচ্চতা ৮২ মিটার। সেতুটির দুপাশে ১৫ ফুট প্রশস্ত ফুটপাত রয়েছে এবং যানবাহন চলাচলের পথটি ৭১ ফুট চওড়া। হাওড়া ব্রিজ নির্মাণে সে সময় মােট খরচ হয়েছিল ২৫ লক্ষ টাকা। ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে জনসাধারণের জন্য নব নির্মিত এই হাওড়া ব্রিজ খুলে দেওয়া হয় এবং ব্রিজটির নামকরণ করা হয় নিউ হাওড়া ব্রিজ। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালের ১৪ই জুন সেতুটির নাম পরিবর্তন করে পুথম ভারতীয় এবং এশিয়ান নােবেল বিজয়ী মহান বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামানুসারে সেতুটির নামকরণ করা হয় রবীন্দ্র সেতু। তবে আজও এই সেতু হাওড়া ব্রিজ নামেই অধিক পরিচিত।

হাওড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে চলমানরত যানবাহন ও লোকজন
হাওড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে চলমানরত যানবাহন ও লোকজন (Howrah Bridge)

ভিডিও


হাওড়া ব্রিজের নির্মাণ কাহিনী | The History of Howrah Bridge in Bengali –

আরো ভিডিও দেখুন

(History of Howrah Bridge in Bengali)

Gobin
Gobinhttps://bengalknowledge24.com/
I am a Content Creator on YouTube, Facebook, Instagram and Bengal Knowledge 24 Website.

আরও পড়ুন

আপনার জন্য বিশেষ নিবন্ধ