About West Bengal state in Bengali
পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি অন্যতম রাজ্য। যার ঐতিহাসিক, ভৌগলিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য দেশের অন্যান্য রাজ্যগুলিকে সত্যিই হার মানায়। যার প্রধান ভাষা বাংলা বিশ্বের সবচেয়ে মধুর ভাষা হিসাবে মর্যাদাপ্রাপ্ত। আধুনিক ভারতের সংস্কৃতি ও সভ্যতার ক্ষেত্রে এই রাজ্যের সমাজসংস্কারক ও বুদ্ধিজীবিরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ রাজা রামমােহন রায়, যার জন্ম এই পশ্চিমবঙ্গে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেও বাংলার ভূমিকা অতুলনীয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্বামী বিবেকানন্দের ন্যায় মহান বঙ্গসন্তানরা মাতৃভূমির প্রতি তাদের অসাধারণ নিষ্ঠা ও দায়বদ্ধতার জন্য আজও সকল ভারতবাসীদের কাছে শ্রদ্ধেয় এবং চিরস্মরণীয়। অস্কার পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশ্ব বিখ্যাত চিত্র পরিচালক সত্যজীৎ রায়ের জন্মস্থানও এই পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের সবচেয়ে মধুর অংশ বলা হয়ে থাকে। তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক ভারতের একটি অন্যতম বিষ্টি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটি সম্পর্কে –
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য
West Bengal State, India
অবস্থান
১৯৪৭ সালে অবিভক্ত বাংলা বিভক্ত হয়ে পশ্চিম অংশ পশ্চিমবঙ্গ নামে ভারতের একটি রাজ্য হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। পূর্ব ভারতে হিমালয়ের দক্ষিণে ও বঙ্গোপসাগরের উত্তরে এক সংকীর্ণ অংশে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটি অবস্থিত। ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ একমাত্র রাজ্য যেটি উত্তরে হিমালয় এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরকে স্পর্শ করেছে। ভারতের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটির পূর্ব দিকে রয়েছে আসাম রাজ্য ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র, পশ্চিমদিকে রয়েছে বিহার, ঝাড়খন্ড ও ওড়িশা রাজ্য, উত্তর দিকে রয়েছে সিকিম রাজ্য এবং নেপাল ও ভুটান রাষ্ট্র এবং দক্ষিণ দিকে রয়েছে বঙ্গোপসাগর।
মানচিত্র
Map of West Bengal State
![]() | ![]() |
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মানচিত্র (Map of West Bengal State with districts) | ভারতের মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অবস্থান (West Bengal state in Map of India) |
আয়তন
আয়তনে ভারতের ত্রয়ােদশতম রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মােট আয়তন ৮৮,৭৫২ বর্গ কিলােমিটার।
জনসংখ্যা
পশ্চিমবঙ্গের মােট জনসংখ্যা ৯১,২৭৬,১১৫ জন, যা জনসংখ্যার বিচারে ভারতের চতুর্থতম রাজ্য।
২০১১ সালের আদমশুমারির বিবরণ অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জনসংখ্যার তথ্য –
Population data of West Bengal state 2011
প্রকৃত জনসংখ্যা | ৯১,২৭৬,১১৫ জন |
পুরুষ | ৪৬,৮০৯,০২৭ জন |
মহিলা | ৪৪,৪৬৭,০৮৮ জন |
জনসংখ্যা বৃদ্ধি | ১৩.৮৪% |
মোট জনসংখ্যার শতাংশ | ৭.৫৪% |
লিঙ্গ অনুপাত | ৯৫০ |
শিশু লিঙ্গ অনুপাত | ৯৫৬ |
ঘনত্ব/বর্গ কিমি | ১,০২৮ |
এলাকা (বর্গ কিমি) | ৮৮,৭৫২ |
মোট শিশু জনসংখ্যা (০-৬ বয়স) | ১০,৫৮১,৪৬৬ জন |
সাক্ষরতা | ৭৬.২৬% |
পুরুষ সাক্ষরতা | ৮১.৬৯% |
মহিলা সাক্ষরতা | ৭০.৫৪% |
নামকরণ
বৃহত্তর বঙ্গদেশে সভ্যতার সূচনা ঘটে আজ থেকে প্রায় ৪০০০ বছর আগে। এই সময় দ্রাবিড়, তিব্বতি-বর্মি ও অস্ত্রো-এশীয় জাতিগােষ্ঠী এই অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। ‘বঙ্গ’ বা ‘বাংলা’ শব্দের প্রকৃত উৎস অজ্ঞাত। তবে মনে করা হয় ১০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ যে দ্রাবিড়-ভাষী ‘বং’ জাতিগােষ্ঠী এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল তারই নামানুসারে এই অঞ্চলের নামকরণ হয় ‘বঙ্গ’ বা ‘বাংলা’।
ইতিহাস
খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে বাংলা ও বিহার অঞ্চল নিয়ে গড়ে ওঠে মগধ রাজ্য। বঙ্গের প্রথম সার্বভৌম রাজা ছিলেন শশাঙ্ক। এরপর চারশাে বছর বৌদ্ধ পাল রাজবংশ এবং তারপর কিছুকাল হিন্দু সেন রাজবংশ এই অঞ্চল শাসন করেন। এরপর বখতিয়ার খলজি সর্বশেষ সেন রাজা লক্ষণসেনকে পরাস্ত করে বঙ্গের একটি বিরাট অঞ্চল অধিকার করে নেন।
পরবর্তীতে ষােড়শ শতাব্দীতে মুঘল সেনানায়ক ইসলাম খা বঙ্গ অধিকার করেন। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে বঙ্গ অঞ্চলে ইউরােপীয় বণিকদের আগমন ঘটে। অবশেষে ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলাকে পরাজিত করেন। ফলে বাংলায় ব্রিটিশদের শাসনকার্য শুরু হয়। সেইসময় ১৭৭২ সালে কোলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ঘােষিত হয়।
তবে এরপর ব্রিটিশদের শাসনে অতিষ্ট হয়ে শুরু হয় স্বাধীনতা আন্দোলন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বঙ্গবাসী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শেষমেশ ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। তবে এই স্বাধীনতা অর্জন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের চক্রান্তে ধর্মের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। ফলে বঙ্গ বা বাংলা অঞ্চলটি দুটি খন্ডে বিভক্ত হয়ে যায়। হিন্দুপ্রধান পশ্চিম খন্ড পশ্চিমবঙ্গ নামে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ইসলামপ্রধান পূর্ব খন্ড সেইসময় পূর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়, যা বর্তমানে বাংলাদেশ নামে স্বীকৃত।
১৯৫০ সালে দেশীয় রাজ্য কোচবিহারের রাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভারত সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলে কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলায় পরিণত হয়। ১৯৫৫ সালে ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগর পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়। বিহারের কিছু বাংলা-ভাষী অঞ্চলও এইসময় পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়। এইভাবেই ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য তার বর্তমান রূপ লাভ করে।
প্রশাসনিক বিভাগ ও পরিকাঠামো
রাজধানী
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কোলকাতা শহর, যা এই রাজ্যের বৃহত্তম শহর এবং ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম মহানগরী।
বিভাগ
প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে পশ্চিমবঙ্গকে ৫টি বিভাগে বিভক্ত করা হয়েছে, এগুলি হল –
- জলপাইগুড়ি বিভাগ,
- মালদা বিভাগ,
- বর্ধমান বিভাগ,
- প্রেসিডেন্সি বিভাগ ও
- মেদিনীপুর বিভাগ।
জেলা
৫টি বিভাগের অন্তর্গত বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে মােট ২৩টি জেলা রয়েছে, যার সর্বশেষ অর্থাৎ ২৩তম জেলা হিসাবে যুক্ত হয়েছে পশ্চিম বর্ধমান জেলা। এই ২৩টি জেলায় পশ্চিমবঙ্গে মােট ৬৬টি মহকুমা রয়েছে, রয়েছে ৩৪১টি ব্লক, ১২১টি পৌরসভা এবং ৬টি পৌরসংস্থা।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মােট ২৩টি জেলা হল –
District list of West Bengal state
জেলা | সদর দপ্তর | জনসংখ্যা (২০১১ জনগণনা) | আয়তন (বর্গ কিমি) |
কোচবিহার জেলা | কোচবিহার | ২,৮১৯,০৮৬ | ৩,৩৮৭ |
আলিপুরদুয়ার জেলা | আলিপুরদুয়ার | ১,৪৯১,২৫০ | ৩,৩৮৩ |
জলপাইগুড়ি জেলা | জলপাইগুড়ি | ২,৩৮১,৫৯৬ | ৬,২২৭ |
কালিম্পং জেলা | কালিম্পং | ২৫১,৬৪২ | ১,০৪৪ |
দার্জিলিং জেলা | দার্জিলিং | ১,৫৯৫,১৮১ | ৩,১৪৯ |
উত্তর দিনাজপুর জেলা | রায়গঞ্জ | ৩,০০৭,১৩৪ | ৩,১৪০ |
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা | বালুরঘাট | ১,৬৭৬,২৭৬ | ২,২১৯ |
মালদহ জেলা | ইংলিশবাজার | ৩,৯৮৮,৮৪৫ | ৩,৭৩৩ |
মুর্শিদাবাদ জেলা | বহরমপুর | ৭,১০৩,৮০৭ | ৫,৩২৪ |
বীরভূম জেলা | সিউড়ি | ৩,৫০২,৪০৪ | ৪,৫৪৫ |
পূর্ব বর্ধমান জেলা | বর্ধমান | ৪,৮৩৫,৫৩২ | ৫,৪৩২.৬৯ |
পশ্চিম বর্ধমান জেলা | আসানসোল | ২,৮৮২,০৩১ | ১,৬০৩.১৭ |
নদিয়া জেলা | কৃষ্ণনগর | ৫,১৬৭,৬০১ | ৩,৯২৭ |
হুগলী জেলা | চুঁচুড়া | ৫,৫১৯,১৪৫ | ৩,১৪৯ |
বাঁকুড়া জেলা | বাঁকুড়া | ৩,৫৯৬,৬৭৪ | ৬,৮৮২ |
পুরুলিয়া জেলা | পুরুলিয়া | ২,৯৩০,১১৫ | ৬,২৫৯ |
পূর্ব মেদিনীপুর জেলা | তমলুক | ৫,০৯৫,৮৭৫ | ৪,৭৮৫ |
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা | মেদিনীপুর | ৪,৭৭৬,৯০৯ | ৬,৩০৮ |
ঝাড়গ্রাম জেলা | ঝাড়গ্রাম | ১,১৩৬,৫৪৮ | ৩,০৩৭.৬৪ |
উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলা | বারাসত | ১০,০০৯,৭৮১ | ৪,০৯৪ |
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলা | আলিপুর | ৮,১৬১,৯৬১ | ৯,৯৬০ |
হাওড়া জেলা | হাওড়া | ৪,৮৫০,০২৯ | ১,৪৬৭ |
কলকাতা জেলা | কলকাতা | ৪,৪৯৬,৬৯৪ | ২০৬.০৮ |
আইনসভা
২৯৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত পশ্চিমবঙ্গের আইনসভা এককক্ষ বিশিষ্ট, যা পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নামে পরিচিত। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য থেকে ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় ৪২ জন ও উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় ১৬ জন সদস্য প্রতিনিধিত্ব করেন।
বিচার ব্যবস্থা
পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ বিচারালয় হল কলকাতা হাইকোর্ট। কলকাতা হাইকোর্ট ও অন্যান্য নিম্ন আদালত নিয়ে এই রাজ্যের বিচারবিভাগ গঠিত।
রাজ্য প্রতীক
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজ্য প্রতীকগুলি হল –
State Symbols of West Bengal state
রাজ্য সিলমোহর | পশ্চিমবঙ্গের প্রতীক (Emblem of West Bengal) | ![]() |
রাজ্য নীতিবাক্য | সত্যমেব জয়তে सत्यमेव जयते Satyameva Jayate (Truth Alone Triumphs) | |
রাজ্য গান | বাংলার মাটি বাংলার জল Banglar Mati Banglar Jol (The Soil of Bengal, The Water of Bengal) | |
রাজ্য পশু | মেছাে বাঘ বা মেছাে বিড়াল (Fishing cat) | ![]() |
রাজ্য পাখি | সাদাবুক মাছরাঙা (White-throated kingfisher) | ![]() |
রাজ্য গাছ | ছাতিম (Blackboard tree) | ![]() |
রাজ্য ফুল | শিউলি (Night-flowering jasmine) | ![]() |
রাজ্য ফল | আম (Mango) | ![]() |
রাজ্য মাছ | ইলিশ (Ilish) | ![]() |
শহর
রাজ্যের রাজধানীর পাশাপাশি কোলকাতা শহর হল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বৃহত্তম শহর এবং ভারতের তৃতীয় বৃহৎ মহানগর। উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি শহরটি হল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অপর এক অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন মহানগর এবং আসানসোল ও দুর্গাপুর হল এই রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের শিল্পতালুকে অবস্থিত অপর দুটি মহানগর। এই রাজ্যের অন্যান্য শহরগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল হাওড়া, রাণীগঞ্জ, হলদিয়া, জলপাইগুড়ি, খড়গপুর, বর্ধমান, দার্জিলিং, মেদিনীপুর, তমলুক, ইংরেজ বাজার, কোচবিহার ও আরামবাগ।
ভূপ্রকৃতি
উত্তর থেকে দক্ষিণ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রাকৃতিক সৌন্দৰ্য্যও অপরূপ। রাজ্যের সর্বোত্তরে অবস্থিত দার্জিলিং হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল পূর্ব হিমালয়ের একটি অংশ। পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ সান্দাকফু (উচ্চতা ৩,৬৩৬ মিটার) এই অঞ্চলেই অবস্থিত।

এই রাজ্যের সর্বদক্ষিণে একটি নাতিদীর্ঘ উপকূলীয় সমভূমিও বিদ্যমান। পৃথিবীর বৃহত্তম নদী ব-দ্বীপ গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের কিছু অংশ ভারতের এই রাজ্যের অন্তর্গত।
নদনদী
প্রবাহিত নদীগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের প্রধান নদী হল গঙ্গা, যার একটি শাখা পদ্মা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং অপর শাখাটি ভাগীরথী ও হুগলি নামে পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য প্রধান নদনদীগুলি হল তিস্তা, তাের্সা, জলঢাকা, ফুলহার, মহানন্দা, দামােদর, অজয়, কংসাবতী ইত্যাদি।

জলবায়ু
পশ্চিমবঙ্গ গ্রীষ্মপ্রধান উষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত। এই রাজ্যের প্রধান ঋতু চারটি – শুষ্ক গ্রীষ্মকাল, আর্দ্র গ্রীষ্মকাল বা বর্ষাকাল, শরৎকাল ও শীতকাল। এ রাজ্যে গ্রীষ্মকালে গড় তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে থাকে। তবে এই রাজ্যের শীতকাল আরামদায়ক। এইসময় রাজ্যের সমভূমি অঞ্চলের গড় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হয় ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে দার্জিলিং হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে প্রচন্ড ঠান্ডা পড়ে এবং এই সময়ে এই অঞ্চলের কোথাও কোথাও তুষারপাতও হয়ে থাকে।
উদ্ভিদ ও প্রাণীজগত
পশ্চিমবঙ্গ জৈব বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ একটি রাজ্য। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবনের একটি অংশ পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিনাঞ্চলে অবস্থিত। এছাড়াও সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের জন্য বিখ্যাত।

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে মােট ছয়টি জাতীয় উদ্যান রয়েছে – সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান, বক্সা জাতীয় উদ্যান, গােরুমারা জাতীয় উদ্যান, নেওড়া উপত্যকা জাতীয় উদ্যান, সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যান ও জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান। এই রাজ্যের অন্যান্য বন্যপ্রাণীদের মধ্যে ভারতীয় গন্ডার, এশীয় হাতি, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ বাইসন, চিতাবাঘ, কুমির ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য।
অর্থনীতি
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অর্থনীতি মূলত চাকুরি, কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রের উপর নির্ভরশীল। রাজ্যের মােট আভ্যন্তরিণ উৎপাদনের ৫১ শতাংশ আসে চাকুরিক্ষেত্র থেকে, ২৭ শতাংশ আসে কৃষিক্ষেত্র থেকে এবং ২২ শতাংশ আসে শিল্পক্ষেত্র থেকে। ভারতের সাকুল্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে অবদানের অনুপাতে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ষষ্ঠ।
কৃষি
পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপ্রধান রাজ্য। এই রাজ্যের অধিকাংশ মানুষই কৃষিজীবী। এছাড়াও এই রাজ্যের অনুকূল পরিবেশ কৃষিকাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। উৎপাদিত ফসলগুলির মধ্যে এই রাজ্যের প্রধান খাদ্যফসল হল ধান এবং অন্যান্য খাদ্যফসলের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল ডাল, তৈলবীজ, গম, তামাক, আখ ও আলু। আর পাট হল এই রাজ্যের প্রধান পণ্যফসল।

ধান ও সবজি উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে এবং আলু উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এছাড়াও উচ্চ মানের চা উৎপাদনে এই রাজ্যের সুপরিচিতি রয়েছে। উত্তরবঙ্গের দার্জিলিংয়ের চা পৃথিবী বিখ্যাত।
শিল্প
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রধান প্রধান শিল্পকেন্দ্রগুলি কোলকাতা ও কোলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত। দূর্গাপুর-আসানসােল কয়লাখনি অঞ্চলে রাজ্যের প্রধান প্রধান ইস্পাতকেন্দ্রগুলি অবস্থিত।
খনিজ সম্পদ
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটি খনিজ সম্পদে মাঝারিমানের সমৃদ্ধ রাজ্য। এই রাজ্যের প্রধান খনিজ সম্পদ হল কয়লা, যা দেশের মধ্যে কয়লা উত্তোলনে এই রাজ্য সপ্তম স্থানে রয়েছে এবং দ্বিতীয় প্রধান খনিজ সম্পদ হল ফায়ার ক্লে বা তাপসহ মাটি। অন্যান্য খনিজ দ্রব্যের মধ্যে চিনামাটি, চুনাপাথর, অ্যাপেটাইট, আকরিক লােহা, আকরিক তামা, ম্যাঙ্গানিজ, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।
ভাষা
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রধান ভাষা হল বাংলা, যা এই রাজ্যের বসবাসকারী বেশীরভাগ মানুষদের মাতৃভাষা। তবে এই রাজ্যে হিন্দি, সাঁওতালি, উর্দু, নেপালী, ওড়িয়া, সাদরি, রাজবংশী ইত্যাদি ভাষাও প্রচলিত।
ধর্ম
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ৭০% হিন্দু ধর্মাবলম্বী, ২৭% ইসলাম ধর্মাবলম্বী এবং জনসংখ্যার অবশিষ্ট অংশ শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী।
শিক্ষা
শিক্ষাগত দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের মােট সাক্ষরতার হার ৭৭.০৮ শতাংশ।
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কোলকাতাকে বলা হয় দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ অসামান্য সাহিত্যস্রষ্টার জন্মস্থান হল এই পশ্চিমবঙ্গ।
সঙ্গীত
পশ্চিমবঙ্গ রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্মভূমি। সঙ্গীতের এই ধারাটিকে জনপ্রিয় করেছেন স্বয়ং কবি ও গীতিকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই রাজ্যের জনপ্রিয় অন্যান্য সঙ্গীত ধারাগুলি হল বাউল গান, নজরুলগীতি, গম্ভীরা, ভাওয়াইয়া, অতুলপ্রসাদী, দ্বিজেন্দ্রগীতি ইত্যাদি।
চলচ্চিত্র
চলচ্চিত্রেও ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা পরিচালক ও সেরা চলচ্চিত্রের পুরষ্কার সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন বাঙালি পরিচালকেরা। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ বিশিষ্ট পরিচালকের চলচ্চিত্র বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
শিল্পকলা
পশ্চিমবঙ্গ ভারতীয় শিল্পকলার অধুনিকতার পথপ্রদর্শক। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলা হয় আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলার জনক। এই ধারার অন্যান্য বিশিষ্ট চিত্রকরেরা হলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রামকিঙ্কর বেইজ ও যামিনী রায়।
উৎসব
পশ্চিমবঙ্গ তথা বাঙালির বৃহত্তম উৎসব হল দুর্গাপূজা। শরৎকালে আশ্বিন-কার্তিক মাসে চারদিনব্যাপী এই উৎসব আয়ােজিত হয়ে থাকে। এছাড়াও এই রাজ্যে কালী পূজা, ঈদ, দোলযাত্রা, পহেলা বৈশাখ, নবান্ন, বুদ্ধপূর্ণিমা ইত্যাদি আরাে অনেক উৎসব পালিত হয়ে থাকে।
খেলাধুলা
খেলাধুলা হিসাবে ক্রিকেট ও ফুটবল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জনপ্রিয় খেলা। কোলকাতা ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। খাে খাে, কবাডি প্রভৃতি দেশীয় খেলাও এই রাজ্যে হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে একাধিক সুবৃহৎ স্টেডিয়াম অবস্থিত। সারা বিশ্বে যে দুটি মাত্র লক্ষ-আসন বিশিষ্ট ক্রিকেট স্টেডিয়াম রয়েছে, কোলকাতার ইডেন গার্ডেনস তার অন্যতম। অন্যদিকে বিধাননগরের বহুমুখী স্টেডিয়াম যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফুটবল স্টেডিয়াম।
মহান ব্যক্তিত্ব
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কয়েকজন মহান ব্যক্তি হলেন –
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : বাংলাভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক এবং ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা।
- রাজা রামমােহন রায় : ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ এবং বাংলার নবজাগরণের জনক।
- সুভাষ চন্দ্র বসু : ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক চিরস্মরণীয় কিংবদন্তি নেতা।
- স্বামী বিবেকানন্দ : ইউরােপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম বেদান্ত ও যােগ দর্শনের প্রচারক, বীর সন্ন্যাসী এবং রামকৃষ্ণ মিশন ও রামকৃষ্ণ মঠের প্রতিষ্ঠাতা।
- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : উনবিংশ শতকের একজন বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার।
- বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : উপন্যাসের জনক এবং সাহিত্য সম্রাট হিসেবে পরিচিত উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি ঔপন্যাসিক।
- কাজি নজরুল ইসলাম : বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙ্গালী কবি ও সঙ্গীতকার।
- সত্যজিৎ রায় : অস্কার পুরুষ্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সংগীত পরিচালক এবং লেখক। – প্রমুখ।
পরিবহন ব্যবস্থা
পরিবহন ব্যবস্থা হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে উন্নতমানের সড়কপথ, রেলপথ, আকাশপথ ও জলপথেরও ব্যবস্থা রয়েছে।
কোলকাতা মেট্রো ভারতের প্রথম ভূগর্ভস্থ মেট্রো রেল পরিষেবা। উত্তরপূর্ব সীমান্ত রেলের অংশ দার্জিলিং হিমালয়ান রেল একটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত।
পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, যা কোলকাতার নিকটেই উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার দমদমে অবস্থিত। এছাড়াও শিলিগুড়ির নিকটবর্তী বাগডােগরা বিমানবন্দর এবং কোচবিহার জেলার কোচবিহার বিমানবন্দর রাজ্যের গুরুতুপূর্ণ বিমানবন্দর।
জলপথ হিসাবে কলকাতা বন্দর পূর্ব ভারতের একটি প্রধান নদীবন্দর।
পর্যটন
পশ্চিবঙ্গ রাজ্যের কয়েকটি উল্লেখযােগ্য পর্যটন স্থান হল –
কোলকাতা শহর
শিল্প, সংস্কৃতি ও আধুনিকতার সংমিশ্রণে ঘেরা ঐতিহ্যপূর্ণ এই কোলকাতা শহর পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে জনপ্রিয় শহর। এই শহরের দর্শণীয় স্থানগুলি হল – ভিক্টোরিয়া মেমােরিয়াল, ফোর্ট উইলিয়াম, জাতীয় জাদুঘর, দক্ষিণেশ্বর মন্দির, বিদ্যাসাগর সেতু ইত্যাদি।
![]() | |
ভিক্টোরিয়া মেমােরিয়াল | |
দার্জিলিং
সবুজে সবুজ দিয়ে আবৃত এবং পাহাড় ও তুষারশৃঙ্গ দ্বারা পরিবেষ্টিত দার্জিলিং প্রাকৃতিক মনােরম দৃশ্যের এক অন্যতম জায়গা।
ডুয়ার্স
রাজ্যের উত্তরে অবস্থিত মনমুগ্ধকর পাহাড়, ঝকঝকে নদী বিস্তৃত চা বাগান এবং বিদেশী উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতে সজ্জিত এই ডুয়ার্স অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলির মধ্যে একটি।
সুন্দরবন
রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল সুন্দরবন হল পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য, যা পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে দুঃসাহসিক পর্যটন স্থানগুলির মধ্যে একটি।
দীঘা
পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকত হল দিঘা। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনােমুগ্ধকর ও লােভনীয়।
এছাড়াও –
- শান্তিনিকেতন,
- হাজার দুয়ারী রাজপ্রাসাদ,
- নবদ্বীপ,
- বিষ্ণুপুর মন্দির শহর,
- হাওড়া ব্রিজ ইত্যাদি।
ভিডিও
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য | About West Bengal state in Bengali | All the information about West Bengal state in Bengali –
আরো ভিডিও দেখুন
(Explanation of West Bengal State in Bengali)