Explanation of Nadia District in Bengali
নদীয়া জেলা (Nadia District)
পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলির মধ্যে একটি অন্যতম উল্লেখযােগ্য জেলা হল নদীয়া জেলা। নদীয়া পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম জেলাগুলির মধ্যে একটি এবং প্রাচীন সংস্কৃত শিক্ষাকেন্দ্র। নদীয়া পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঐতিহ্যবাহী শহর কৃষ্ণনগর হল জেলার সদর দফতর। এর মধ্যে রয়েছে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। কর্কটক্রান্তি জেলাকে দুটি ভাগে ভাগ করেছে। নদী থেকে বন, তাঁত থেকে শারপুরিয়া পর্যন্ত এই জেলার বিস্তৃত পরিসর রয়েছে।
মানচিত্র
প্রতিষ্ঠিত
নদীয়া জেলাটি স্থাপিত হয় ১৭৮৭ সালে।
আয়তন
নদীয়া জেলার মােট আয়তন ৩,৯২৭ বর্গ কিলােমিটার।
জনসংখ্যা
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, নদীয়া জেলার মােট জনসংখ্যা ৫,১৬৭,৬০০ জন।
- পুরুষ জনসংখ্যা – ২,৬৫৩,৭৬৮ জন
- মহিলা জনসংখ্যা – ২,৫১৩,৮৩২ জন
- জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার – ১২.২২%
- জনঘনত্ব – ১,৩১৬ জন/বর্গ কিলোমিটার
- লিঙ্গ অনুপাত – ৯৪৭ জন মহিলা/১০০০ জন পুরুষ
- স্বাক্ষরতা – ৭৪.৯৭%
সীমানা
ভৌগলিক অবস্থানগত দিক থেকে নদীয়া জেলার উত্তর সীমান্তে রয়েছে মুর্শিদাবাদ জেলা, দক্ষিণ সীমান্তে রয়েছে উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলা, পূর্বে রয়েছে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমে রয়েছে বর্ধমান ও হুগলি জেলা।
নামকরণ ও ইতিহাস
ইতিহাস অনুযায়ী রাজা বল্লাল সেন নদিয়া জায়গাটির প্রতিষ্ঠা করেন। যা রাজা বল্লাল সেনের শাসন আমলে বাংলার রাজধানী ছিল। নদীয়া নামের উৎস সম্বন্ধে নানা ধারণা প্রচলিত আছে। নদীয়ার নামকরণ প্রসঙ্গে কান্তিচন্দ্র রাঢ়ীর একটি কিংবদন্তির উল্লেখ থেকে জানা যায়, ভাগীরথী তীরস্থ নবসৃষ্ট চরভূমিতে এক তান্ত্রিক প্রতিদিন সন্ধ্যায় নটি দিয়া জ্বালিয়ে তন্ত্র সধনা করতেন। দূর থেকে দেখে লােকে এই দ্বীপটিকে নদিয়ার চর বলত। আর সেই থেকেই নাকি লােকমুখে নদীয়া নামের প্রচলন শুরু হয়। এরপর ১৭৮৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বকালে জেলা হিসাবে নদীয়ার আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরবর্তীকালে দেশভাগের কারণে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট সময়িকভাবে এই জেলা পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয়। তিন দিন বাদে ১৮ আগস্ট কিছু অংশ বাদে নদীয়া পুনরায় ভারত অধিরাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়। তবে ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি নদীয়া জেলা তার বর্তমান রূপটি লাভ করে।
প্রশাসনিক বিভাগ
জেলা সদর : নদীয়া জেলার জেলা সদর হল কৃষ্ণনগর।
মহকুমা : নদীয়া জেলার মহকুমা ৪টি, এগুলি হল –
- কৃষ্ণনগর সদর মহকুমা,
- কল্যাণী মহকুমা,
- রানাঘাট মহকুমা ও
- তেহট্ট মহকুমা।
পৌরসভা : নদীয়া জেলার পৌরসভা ১১টি, এগুলি হল –
- কল্যাণী পৌরসভা,
- কুপার্স ক্যাম্প পৌরসভা,
- কৃষ্ণনগর পৌরসভা,
- গয়েশপুর পৌরসভা,
- চাকদাহা পৌরসভা,
- তাহেরপুর পৌরসভা,
- নবদ্বীপ পৌরসভা,
- বীরনগর পৌরসভা,
- রানাঘাট পৌরসভা,
- শান্তিপুর পৌরসভা ও
- হরিণঘাটা পৌরসভা।
ব্লক : নদীয়া জেলার ব্লক সংখ্যা হল ১৮টি, এগুলি হল –
- কালীগঞ্জ,
- নাকাশিপাড়া,
- চাপড়া,
- কৃষ্ণগঞ্জ,
- কৃষ্ণনগর-১,
- কৃষ্ণনগর-২,
- নবদ্বীপ,
- রানাঘাট-১,
- রানাঘাট-২,
- শান্তিপুর,
- হাঁসখালি,
- কল্যাণী,
- চাকদহ,
- হরিণঘাটা,
- করিমপুর-১,
- করিমপুর-২,
- তেহট্ট-১ ও
- তেহট্ট-২।
থানা : নদীয়া জেলায় ২৮টি থানা রয়েছে।
সেন্সাস টাউন : নদীয়া জেলায় রয়েছে ১৫টি সেন্সাস টাউন।
পঞ্চায়েত সমিতি : নদীয়া জেলায় ১৮টি পঞ্চায়েত সমিতি রয়েছে।
গ্রাম পঞ্চায়েত : নদীয়া জেলায় ১৮৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে।
গ্রাম : নদীয়া জেলায় রয়েছে ১,৩৫২টি গ্রাম।
জেলা পরিষদ : নদীয়া জেলার জেলা পরিষদের সংখ্যা ১টি।
লােকসভা কেন্দ্র : নদীয়া জেলায় লােকসভা কেন্দ্র রয়েছে ২টি, একটি কৃষ্ণনগর লােকসভা কেন্দ্র ও আর একটি রানাঘাট লােকসভা কেন্দ্র।
বিধানসভা কেন্দ্র : নদীয়া জেলায় বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে ১৭টি, এগুলি হল –
- ৭৭ – করিমপুর বিধানসভা কেন্দ্র,
- ৭৮ – তেহট্ট বিধানসভা কেন্দ্র,
- ৭৯ – পলাশীপাড়া বিধানসভা কেন্দ্র,
- ৮০ – কালীগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্র,
- ৮১ – নাকাশিপাড়া বিধানসভা কেন্দ্র,
- ৮২ – চাপড়া বিধানসভা কেন্দ্র,
- ৮৩ – কৃষ্ণনগর উত্তর বিধানসভা কেন্দ্র,
- ৮৪ – নবদ্বীপ বিধানসভা কেন্দ্র,
- ৮৫ – কৃষ্ণনগর দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্র,
- ৮৬ – শান্তিপুর বিধানসভা কেন্দ্র,
- ৮৭ – রানাঘাট উত্তর পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্র,
- ৮৮ – কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্র (এস.সি),
- ৮৯ – রানাঘাট উত্তর পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্র (এস.সি),
- ৯০ – রানাঘাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্র (এস.সি),
- ৯১ – চাকদহ বিধানসভা কেন্দ্র,
- ৯২ – কল্যাণী বিধানসভা কেন্দ্র (এস.সি) ও
- ৯৩ – হরিণঘাটা বিধানসভা কেন্দ্র (এস.সি)।
দাপ্তরিক ওয়েবসাইট : https://nadia.gov.in/
ভূ-প্রকৃতি
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রেসিডেন্সি বিভাগের একটি জেলা এই নদীয়া জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও অপরূপ। গঙ্গা-ভাগীরথী ও তার অন্যান্য উপনদী দ্বারা গঠিত নদীয়া জেলা মূলত বিশাল গাঙ্গেয় সমভূমির একটি অংশ। এই জেলার স্বাভাবিক ভূমিঢাল দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, তবে বর্তমান ভূমির ঢাল খুব কম এবং ঝিল, পুরনাে নদীখাত ও জলাভূমি দ্বারা বিচ্ছিন্ন।
নদ-নদী
নদীয়া জেলার মধ্য দিয়ে অসংখ্য নদনদী প্রবাহিত। নদীয়া জেলার প্রধান নদনদীগুলি হল ভাগীরথী, জলঙ্গী, ভৈরব, চূর্ণী, মাথাভাঙা, ইচ্ছামতী ইত্যাদি।
অভয়ারণ্য
নদীয়া জেলার নাকাশিপাড়া ব্লকের বেথুয়াডহরিতে বেথুয়াডহরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এই জেলার একমাত্র বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। এই অভয়ারণ্যে চিত্রা হরিণ, বেজী খরগােশ, অজগর, ঘড়িয়াল প্রভৃতি বন্যপ্রাণী দেখা যায়।
জলবায়ু
নদীয়া জেলার জলবায়ু উষও আর্দু ক্রান্তীয় মৌসুমি প্রকৃতির। এই জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এবং সর্বনিম তাপমাত্রা ৯ ডিগ্নি, সেন্টিগ্রেড। এই জেলার বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১২০০-১৪০০ মিমি।
কৃষিকাজ
নদীয়া জেলা মূলত একটি কৃষিপ্রধান জেলা। এই জেলার অনুকুল পরিবেশে ধান, গম, আখ, পাট থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকমের শাকসবজি, ফলমূল ও তৈলবীজ উৎপাদিত হয়।
ভাষা
নদীয়া জেলায় বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষদের প্রধান ভাষা হল বাংলা। তবে এই জেলায় হিন্দি, সাদরি প্রভৃতি আরাে অন্যান্য ভাষাও প্রচলিত।
ধৰ্ম
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, পুরুলিয়া জেলার মোট জনসংখ্যার ৭২.১৫% মানুষ হিন্দু ধৰ্ম, ২৬.৭৬% মানুষ ইসলাম ধৰ্ম, ০.৬৫% মানুষ খ্রিস্টান ধর্ম এবং বাকি মানুষেরা অন্যান্য ধৰ্ম পালন করেন।
শিক্ষা
নদীয়া জেলার মােট শিক্ষার হার ৭৪.৯৭ শতাংশ। এই জেলার উল্লখযােগ্য কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হল –
- ইউনিভার্সিটি অফ কল্যাণী,
- বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়,
- কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজ,
- কৃষ্ণনগর ওমেনস্ কলেজ,
- কল্যাণী মহাবিদ্যালয়,
- কল্যাণী গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ,
- রানাঘাট কলেজ,
- দ্বিজেন্দ্রলাল কলেজ,
- তেহট্ট গভর্নমেন্ট কলেজ,
- নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজ ইত্যাদি।
পরিবহন ব্যবস্থা
নদীয়া জেলায় পরিবহন ব্যবস্থা হিসাবে উন্নত সড়কপথ তাে রয়েছেই, সঙ্গে রেলপথও রয়েছে। এই জেলার কয়েকটি উল্লেখযােগ্য রেলওয়ে স্টেশন হল – নবদ্বীপ ধাম রেলওয়ে স্টেশন, কৃষ্ণনগর সিটি জংশন রেলওয়ে স্টেশন, বেথুয়াডহরি রেলওয়ে স্টেশন, রাণাঘাট জংশন রেলওয়ে স্টেশন ইত্যাদি।
বিশিষ্ট ব্যক্তি
নদীয়া জেলার কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হলেন –
- কৃত্তিবাস ওঝা : রামায়নের প্রাচীন অনুবাদক ও কবি।
- শ্রী চৈতন্যদেব : মহাপুরুষ, সমাজসংস্কারক, বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক।
- দীনবন্ধু মিত্র : নাট্যকার, সাহিত্যিক।
- দ্বিজেন্দ্রলাল রায় : প্রখ্যাত কবি ও নাট্যকার।
- সুমিত্র চ্যাটার্জি : অভিনেতা, নাট্যকার।
- ঝুলন গোস্বামী : একজন ভারতীয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার।
- সুধীর চক্রবর্তী : একজন বাঙালী অধ্যাপক, লেখক, গবেষক এবং লােকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ। – প্রমুখ।
দর্শনীয় স্থান
নদীয়া জেলার উল্লেখযােগ্য দর্শনীয় স্থানগুলি হল –
নবদ্বীপ
কৃষ্ণনগর থেকে প্রায় ২০ কিলােমিটার দুরে ভাগীরথী নদীর পশ্চিম পাশে অবস্থিত মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যের জন্মের সাথে জড়িত এই নবদ্বীপ জায়গাটি বেশ কয়েকটি মন্দির ও তীর্থস্থানের জন্য বিখ্যাত। নবদ্বীপ ছিল সেন রাজবংশের বিখ্যাত শাসক লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী, যিনি ১১৭৯ থেকে ১২০৩ সাল পর্যন্ত শাসন করেছিলেন। ১৮৩৫ সালে সূক্ষ্ম ফুলের নকশায় নির্মিত দ্বাদস শিব মন্দিরটি বিপুল সংখ্যক তীর্থযাত্রীকে আকর্ষণ করে।
মায়াপুর
নবদ্বীপের কাছে জলঙ্গী এবং গঙ্গা নদীর সঙ্গমস্থলের তীরে ইসকনের সদর দপ্তর মায়াপুর অবস্থিত। হিন্দুধর্মে এই স্থানটিকে অনেক অনন্য ঐতিহ্যের দ্বারা একটি পবিত্র স্থান হিসাবে বিবেচনা করা হয়, তবে চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান হিসাবে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের অনুসারীদের কাছে এটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, যাকে কৃষ্ণের বিশেষ অবতার হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ইস্কন মন্দির, সরস্বত অদ্বৈত মঠ, চৈতন্য গেঁড়িয়া মঠ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরগুলির জন্য মায়াপুর বিখ্যাত।
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি
জলঙ্গী নদীর তীরে অবস্থিত কৃষ্ণনগর হল নদীয়ার জেলা সদর। কৃষ্ণনগরের নামকরণ করা হয়েছে রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র রায়ের (১৭২৮-১৭৮২) নামে। রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র রায়ের রাজত্বকালে এখানে নির্মিত রাজবাড়িটি পর্যটকদের আকর্ষণের একটি বিশিষ্ট স্থান, যদিও অতীত গৌরবের অবশিষ্টাংশগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে এবং এর ভিতরের দেয়ালে খোদাই করা চমৎকার স্থানগুলির একটি জীর্ণ কাঠামো আজ বিদ্যমান রয়েছে।
শান্তিপুর
নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর থেকে প্রায় ১৮ কিলােমিটার দুরে রানাঘাট মহকুমায় অবস্থিত এই শান্তিপূর জায়গাটি তােপখানা মসজিদ, শ্যাম চাঁদ মন্দির, জলেশ্বর মন্দির এবং এর কাছাকাছি শহর ফুলিয়া কবি কৃত্তবাস ওঝার জন্মস্থানের জন্য বিখ্যাত।
এছাড়াও –
- বেথুয়াডহরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য,
- বল্লাল ঢিপি,
- পলাশির যুদ্ধক্ষেত্র,
- শিব নিবাস,
- ঘূর্ণি,
- রােমান ক্যাথােলিক চার্চ ইত্যাদি।
ভিডিও ↴
নদীয়া জেলার সংক্ষিপ্ত পরিচয় | Explanation of Nadia District in Bengali –
আরো ভিডিও দেখুন
(Explanation of Nadia District in Bengali)