Explanation of Birbhum District in Bengali
বীরভূম জেলা (Birbhum District)
পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলির মধ্যে একটি অন্যতম উল্লেখযােগ্য জেলা হল বীরভূম জেলা। বীরভূমকে বলা হয় রাঙামাটির দেশ। মামা ভাগ্নে পাহাড় এই জেলার একমাত্র পাহাড়। বীরভূম জেলার পশ্চিমাংশ অতীতে বজ্জভূমি বা বজ্রভূমি নামে পরিচিত ছিল।
মানচিত্র


প্রতিষ্ঠিত
বীরভূম জেলাটি স্থাপিত হয় ১৮২০ সালে।
আয়তন
বীরভূম জেলার মােট আয়তন ৪,৫৪৫ বর্গ কিলােমিটার।
জনসংখ্যা
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, বীরভূম জেলার মােট জনসংখ্যা ৩,৫০২,৪০৪ জন। মোট জনসংখ্যার ৯১.০২ শতাংশ মানুষ গ্রামাঞ্চলে বাস করে।
- পুরুষ জনসংখ্যা – ১,৭৯০,৯২০ জন
- মহিলা জনসংখ্যা – ১,৭১১,৪৮৪ জন
- জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার – ১৬.১৫%
- জনঘনত্ব – ৭৭১ জন/বর্গ কিলোমিটার
- লিঙ্গ অনুপাত – ৯৫৬ জন মহিলা/১০০০ জন পুরুষ
- স্বাক্ষরতা – ৭০.৬৮%
সীমানা
ভৌগলিক অবস্থানগত দিক থেকে বীরভূম জেলার উত্তর সীমান্তে রয়েছে মালদহ জেলা, দক্ষিণ সীমান্তে রয়েছে বর্ধমান জেলা, পূর্বে রয়েছে মুর্শিদাবাদ জেলা এবং পশ্চিমে রয়েছে ঝাড়খন্ড রাজ্য।
নামকরণ
বর্তমানে বীরভূম নামে পরিচিত অঞ্চলটি প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই জনবসতিপূর্ণ। বীরভূম নামটির সম্ভাব্য উৎস বীরভূমি শব্দটি, যার অর্থ বীরের দেশ। অন্য একটি মতে, বাগদী রাজা বীর মল্লের নামানুসারে এই জেলার নামকরণ করা হয়েছে, যিনি ১৫০১ থেকে ১৫৫৪ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলের শাসক ছিলেন।
ইতিহাস
১৭৮৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে বীরভূম নামক প্রশাসনিক জেলাটির জন্ম হয়। তার আগে এটি মুর্শিদাবাদ জেলার অংশ ছিল। ১৮৮৭ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বীরভূম জেলা বর্তমান বীরভূম জেলার তুলনায় আকারে অনেক বড়াে একটি জেলা ছিল। কেননা সেই সময় বিষ্ণুপুর ও বাঁকুড়া জেলা এই জেলার অন্তর্গত ছিল। পরবর্তীতে ১৮২০ সালে বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভক্ত হয়ে নতুন করে বর্তমান এই বীরভূম জেলার আত্মপ্রকাশ ঘটে।
প্রশাসনিক বিভাগ
জেলা সদর : বীরভূম জেলার জেলা সদর হল সিউড়ি।
মহকুমা : বীরভূম জেলার মহকুমা ৩টি, এগুলি হল –
- সিউড়ি সদর মহকুমা,
- বােলপুর মহকুমা ও
- রামপুরহাট মহকুমা।
পৌরসভা : পৌরসভা ৬টি, এগুলি হল –
- সিউড়ি পৌরসভা,
- সাঁইথিয়া পৌরসভা,
- দুবরাজপুর পৌরসভা,
- বােলপুর পৌরসভা,
- রামপুরহাট পৌরসভা ও
- নলহাটি পৌরসভা।
ব্লক : বীরভূম জেলার ব্লক সংখ্যা হল ১৯টি, এগুলি হল –
- সিউড়ী-১,
- সিউড়ী-২,
- সাঁইথিয়া,
- মোঃ বাজার,
- রাজনগর,
- খয়রাশোল,
- দুবরাজপুর,
- বোলপুর-শ্রীনিকেতন,
- ইলামবাজার,
- নানুর,
- লাভপুর,
- রামপুরহাট-১,
- রামপুরহাট-২,
- নলহাটি-১,
- নলহাটি-২,
- ময়ূরেশ্বর-১,
- ময়ূরেশ্বর-২,
- মুরারই-১ ও
- মুরারই-২।
থানা : বীরভূম জেলায় ২৭টি পুলিশ স্টেশন রয়েছে।
পঞ্চায়েত সমিতি : বীরভূম জেলায় রয়েছে ১৯টি পঞ্চায়েত সমিতি।
গ্রাম পঞ্চায়েত : বীরভূম জেলায় ১৬৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে।
জেলা পরিষদ : বীরভূম জেলার জেলা পরিষদের সংখ্যা ১টি।
লােকসভা কেন্দ্র : বীরভূম জেলায় লােকসভা কেন্দ্র রয়েছে ২টি, একটি বীরভূম লােকসভা কেন্দ্র ও আর একটি বােলপুর লােকসভা কেন্দ্র।
বিধানসভা কেন্দ্র : বীরভূম জেলায় বিধানসভা কেন্দ্র রয়েছে ১১টি, এগুলি হল –
- সাঁইথিয়া বিধানসভা কেন্দ্র,
- সিউড়ি বিধানসভা কেন্দ্র,
- বােলপুর বিধানসভা কেন্দ্র,
- রামপুরহাট বিধানসভা কেন্দ্র,
- নলহাটি বিধানসভা কেন্দ্র,
- দুবরাজপুর বিধানসভা কেন্দ্র,
- ময়ূরেশ্বর বিধানসভা কেন্দ্র,
- মুরারই বিধানসভা কেন্দ্র,
- লাভপুর বিধানসভা কেন্দ্র,
- নানুর বিধানসভা কেন্দ্র ও
- হাঁসন বিধানসভা কেন্দ্র।
দাপ্তরিক ওয়েবসাইট : https://birbhum.gov.in/
ভূ-প্রকৃতি
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মধ্যভাগে অবস্থিত এই বীরভূম জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যও অপরূপ। বীরভূমকে বলা হয় রাঙামাটির দেশ। এই জেলার ভূসংস্থান ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলার তুলনায় একটু আলাদা। জেলাটির পশ্চিমাঞ্চল ছােটোনাপুর মালভূমির অন্তর্গত ঝােপঝাড়ে পরিপূর্ণ একটি এলাকা। জেলাটি পশ্চিমদিক থেকে ঢালু হয়ে নেমে এসে মিশেছে পূর্বদিকের পলিগঠিত উর্বর কৃষিজমিতে। জেলাটির পশ্চিমদিকে প্রাকৃতিকভাবে পাথুরে গঠনে তৈরী হয়েছে একমাত্র পাহাড় মামাভাগ্নে পাহাড়, যা দুবরাজপুর শহরের সন্নিকটে অবস্থিত। বীরভূম জেলার পশ্চিমাংশ অতীতে বজ্জভূমি বা বজ্রভূমি নামে পরিচিত ছিল।

নদ-নদী
বীরভূম জেলার মধ্য দিয়ে অসংখ্য নদনদী প্রবাহিত, তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল অজয়, ময়ুরাক্ষী, কোপাই, বক্রেশ্বর, ব্রাহ্মণী, দ্বারকা, হিংলাে ইত্যাদি। এই জেলার একটি নদীবাঁধ সিউড়ির নিকট ময়ুরাক্ষী নদীতে তিলপাড়া বাঁধ।

জলবায়ু
বীরভূম জেলার পশ্চিমাংশের জলবায়ু শুষ্ক ও চরম প্রকৃতির এবং পূর্বাংশের জলবায়ু অপেক্ষাকৃত মৃদু। এই জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এরও বেশি এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কম। এই জেলার বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৪৩০.৫ মিমি।
কৃষিকাজ
বীরভূম জেলা মূলত একটি কৃষিনির্ভর জেলা। এই জেলার অধিবাসীদের ৭৫ শতাংশই কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। এই জেলার অনুকূল পরিবেশে ধান, গম, ভুট্টা, আলু থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকমের শাকসবজি, ফলমূল ও তৈলবীজ উৎপাদিত হয়। তবে এই জেলার প্রধান কৃষিকাজ হল তুলা চাষ ও রেশম চাষ।
শিল্প
বীরভূম জেলার শিল্পগুলি হল তাঁত বয়ন, চালকল, তৈলবীজের কল, লাক্ষা উৎপাদন, পাথর খনি, ধাতুশিল্প, মৃৎশিল্প ইত্যাদি। বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এই জেলার একমাত্র বৃহৎশিল্প।
ভাষা
বাংলা ভাষা হল বীরভূম জেলায় বসবাসকারী অধিকাংশ মানুষদের প্রধান ভাষা। তবে এই জেলায় সাঁওতালি, হিন্দি, ওরাওঁ প্রভৃতি আরাে অনেক ভাষাও প্রচলিত।
ধৰ্ম
২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, বীরভূম জেলার মোট জনসংখ্যার ৬২.৩% মানুষ হিন্দু ধৰ্ম, ৩৭.১% মানুষ ইসলাম ধৰ্ম এবং বাকি মানুষেরা অন্যান্য ধর্ম পালন করেন।
শিক্ষা
বীরভূম জেলার মােট শিক্ষার হার ৭০.৬৮ শতাংশ। এই জেলার উল্লখযােগ্য কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হল –
- বিশ্বভারতী ইউনিভার্সিটি,
- বীরভূম মহাবিদ্যালয়,
- বীরভূম গভর্নমেন্ট মেডিক্যাল কলেজ – সিউড়ি,
- বিদ্যাসাগর কলেজ,
- রামপুরহাট কলেজ,
- কবি জয়দেব মহাবিদ্যালয়,
- কবি নজরুল কলেজ,
- অভেদানন্দ মহাবিদ্যালয়,
- পূর্ণিদেবী চৌধুরী গার্লস কলেজ,
- নলহাটি গভর্নমেন্ট পলিটেকনিক কলেজ ইত্যাদি।
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য
ইতিহাসে বীরভূম জেলায় একাধিকবার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়েছে। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এই জেলার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠান। বীরভূম জেলায় অনেক কবির জন্ম হয়েছে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জয়দেব, চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাস।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সুসমৃদ্ধ এই জেলায় একাধিক উৎসব ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা ও জয়দেব কেন্দুলির বাউল মেলা সেগুলির মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বীরভূমের মানুষ যাত্রা, কবিগান ও আলকাপের মতো লোকবিনোদন অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
পরিবহন ব্যবস্থা
বীরভূম জেলায় পরিবহন ব্যবস্থা হিসাবে উন্নত সড়কপথ তাে রয়েছেই, সঙ্গে রেলপথও রয়েছে। এই জেলার কয়েকটি উল্লেখযােগ্য রেলওয়ে স্টেশন হল রামপুরহাট জংশন রেলওয়ে স্টেশন, বােলপুর শান্তিনিকেতন রেলওয়ে স্টেশন, সাইথিয়া জংশন রেলওয়ে স্টেশন, আহমদপুর জংশন রেলওয়ে স্টেশন, সিউড়ি রেলওয়ে স্টেশন ইত্যাদি।

বিশিষ্ট ব্যক্তি
বীরভূম জেলার কয়েকজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তি হলেন –
- তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় : যিনি একজন বিশিষ্ট লেখক ও ঔপন্যাসিক ছিলেন।
- প্রণব মুখোপাধ্যায় : ভারতের ত্রয়ােদশতম রাষ্ট্রপতি।
- অমর্ত্য সেন : ভারতীয় অর্থনীতিবীদ এবং নােবেল জয়ী।
- খরাজ মুখার্জি : বাঙালি অভিনেতা, গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক।
- সুমিত্রা দেবী : ভারতীয় হিন্দি ও বাংলা সিনেমার অভিনেত্রী।
- আনন্দমােহন চক্রবর্তী : ভারতীয় মার্কিন অনুজীববিদ, বিজ্ঞানী গবেষক। – প্রমুখ।
দর্শনীয় স্থান
বীরভূম জেলার উল্লেখযােগ্য দর্শনীয় স্থানগুলি হল –
বােলপুর-শান্তিনিকেতন
ভ্রমণে আগ্রহী ব্যক্তিদের জন্য এক সপ্তাহান্ত নিখুঁত গেটওয়ে গন্তব্য হল এই বােলপুর-শান্তিনিকেতন। এটি মহানগরের উদাসীন গতি এবং দূষণ থেকে দূরে একটি দূর্দান্ত মনােরম জায়গা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এই স্থানটির মূল আকর্ষণ।

তারাপীঠ
তারাপীঠ পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের রামপুরহাটের নিকটে একটি ছােট মন্দির শহর, এটি তান্ত্রিক মন্দির এবং এর সংলগ্ন শ্মশান মাঠের জন্য পরিচিত, যেখানে তান্ত্রিক অনুষ্ঠান হয়। তারাপীঠ সাধক বামাক্ষ্যাপার জন্যও বিখ্যাত।

বক্রেশরের উষ্ণ প্রস্রবণ এবং মহিষমর্দিনীর মন্দির
বীরভূম জেলার বক্রেশ্বরের মহিষমর্দিনীর মন্দির ভারতের ৫১টি শক্তিশালী পিঠগুলির মধ্যে একটি এবং বক্রেশ্বর আটটি হট স্প্রিংয়ের জন্য বিখ্যাত।

ফুল্লারা মাতার মন্দির
বীরভূমের বােলপুর মহকুমার একটি ছােট শহর লাভপুর জায়গাটির মূল আকর্ষণ এই ফুল্লারা মাতার মন্দির। এই মন্দিরটি প্রায় ১০০ বছর পূরানাে।

এছাড়াও –
- পাথরচাপুরি গ্রাম
- বল্লভপুর বন্যজীবন অভয়ারণ্য
- মামা-ভাগ্নে পাহাড়
- সরকার রাজবাড়ি
- আমখই জীবাশ্ম কাঠের পার্ক
- তারাশঙ্কর মিউজিয়াম ইত্যাদি।
ভিডিও ↴
বীরভূম জেলার সংক্ষিপ্ত পরিচয় | Explanation of Birbhum District in Bengali –
আরো ভিডিও দেখুন(Explanation of Birbhum District in Bengali)

